মো. জাকির হোসেন,সলঙ্গা (সিরাজগঞ্জ): প্রতিনিধি:
একসময় যে বাতাসে ধানের গন্ধ ভেসে বেড়াত, আজ সেখানে কেবল বদ্ধ পানির ভ্যাপসা গন্ধ। কৃষকের মুখের হাসির বদলে ফুটে উঠেছে গভীর হতাশা। যে মাঠে একসময় সোনালি ধানের চেনা চিত্র ছিল, আজ সেখানে কেবল দিগন্তবিস্তৃত মাছের ঘের, উঁচু বাঁধ আর সীমারেখা টেনে দেওয়া নীল জাল।
সিরাজগঞ্জের সলঙ্গার চিত্র এটি। বিশেষ করে থানার রামকৃষ্ণপুর, সলঙ্গা, পূর্ণিমাগাঁতীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় চলছে অপরিকল্পিত ও অবৈধ পুকুর খননের মহোৎসব। এতে তিন ফসলি উর্বর কৃষি জমি পরিণত হচ্ছে মাছের ঘেরে। ফলে হাজার হাজার কৃষক হারাচ্ছেন তাদের শেষ সম্বল, আর পুরো এলাকা করছে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়।
রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নে জীর্ণ শরীরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গভীর নলকূপ (ডিপকল) এই পরিবর্তনের জীবন্ত সাক্ষী। একসময় এই ডিপকলটি শত শত বিঘা জমিতে সেচের পানি জুগিয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতো। আজ তার চারপাশে শুধু পানি আর পানি। আশপাশের ফসলি জমিগুলো এখন মাছের ঘেরের দখলে, আর ডিপকলটি রোদে-জলে ক্ষয়ে গিয়ে যেন কৃষির এক সমাধিসৌধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
স্থানীয় এক প্রবীণ শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, “এই ডিপকল ছিল আমাদের এলাকার আত্মার মতো। এখন এটি পরিত্যক্ত, ঠিক যেমন আমাদের কৃষির স্বপ্নগুলোও আজ মৃতপ্রায়।”
স্থায়ী জলাবদ্ধতায় ডুবছে হাজারো বিঘা জমি অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুকুর খনন করে তার চারপাশে উঁচু বাঁধ দেওয়ায় এলাকার স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। ফলে জলশুকা, উনুখাঁ, পাঠানপাড়া, চৈত্রহাটি, পুকুরপার, দবিরগঞ্জ, কুমারগাইলজানি, পাঁচান, কৈমাঝুড়িয়া, খৈইশ্বর, আগরপুর, চকশ্বাদীসহ প্রায় ১২টি গ্রামের প্রায় ৩ হাজার বিঘা তিন ফসলি জমি এখন স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার। বর্ষার পানি মাঠে প্রবেশ করার পর আর বের হতে পারছে না, যা কৃষিকে চিরতরে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
এক কৃষক ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “প্রশাসন চাইলে একদিনেই এই অবৈধ কাজ বন্ধ করতে পারত। আমরা বারবার তাদের কাছে গিয়েছি, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে, যেন কিছুই করার নেই।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভে কৃষকদের নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে বা ভয় দেখিয়ে জমি লিজ নিয়ে পুকুর খনন করছে। এই মাছের সাম্রাজ্যের মুনাফা যাচ্ছে গুটিকয়েক ব্যক্তির পকেটে, আর এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির বোঝা বইতে হচ্ছে পুরো এলাকার সাধারণ মানুষ ও প্রকৃতিকে। হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ, পাখি এবং জলজ প্রাণী, যা পরিবেশের ভারসাম্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এই ধ্বংসযজ্ঞ প্রশাসনের চোখের সামনে ঘটলেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। অবৈধ পুকুর খননকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়াকে সরাসরি প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও উদাসীনতা হিসেবেই দেখছেন ভুক্তভোগীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুসালেহ মোহাম্মদ হাসনাত বলেন, “আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে কথা বলে জলাবদ্ধতা নিরসনে দ্রুত খাল খননের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”