সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি:
বাঁশের খুঁটির উপর পলিথিনের ছাউনি। ভাঙা চৌকি, প্লাস্টিকের ছালা আর পুরাতন কাপড়ের তৈরি বেড়ার ঝুপরি একখানা ঘর। এককটু খানি বৃষ্টি হলেই পলিথিনের ফুটো দিয়ে পড়ে পানি। জসিম উদ্দিনের কবিতার আসমানিদের মতো এমনই একটি ঝুপরি ঘরে প্রতিবন্ধী মেয়ে ও নাতিকে নিয়ে ছয় বছর ধরে বাস করছিলেন শাহিদা বেগম।
বিষয়টি জানতে পেরে ফেসবুকে পোস্ট দেন সমাজকর্মী মামুন বিশ্বাস। আর তার প্রচেষ্টায় সেই শাহিদা পেলেন রঙিন ঘর। ঘরের সঙ্গে একটি টয়লেটও নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এবার শাহিদার খুশি আর ধরে না।
বৃহস্পতিবার (২৮ আগষ্ট) দুপুরে মামুন বিশ্বাস তার সহকর্মী ইসমাইল হোসেন, সেতুসহ অন্যান্যদের সাথে নিয়ে ঘরখানা বুঝিয়ে দেন শাহিদা বেগমকে। সেই সাথে লেপ তোষক, দুই বস্তা চাল, খাদ্য সামগ্রী, সবার জন্য নতুন পোশাক এবং নগদ কিছু টাকাও হাতে তুলে দেন তিনি।
শাহিদা খাতুন বলেন, (তুফানে আমার ঘর উড়ে গিয়েছিল, সেই ঘর আর তুলতে পারলাম না। মাইনসের বাড়ি কামকাজ কইর্যা খাই, মেয়ে শাক তোলে নাতি বেচে, ৫শ টাকা বেতন দিয়্যা মাইনসের বাড়িতে কাম করি। আগে ঘর ঝড়ে উইড়্যা গেছিল, পলিথিন তুইল্যা থাইকতাম। কাগজ ছিড়া যায় মাইনসে দয়া করে আবার কাগজ দেয় আবার ছিড়্যা যায়। ৬/৭ বছর আমি কষ্টই কইরল্যাম। তারপর আমার ভাগনে বইলো সাংবাদিক বইল্যা তোমার জন্য ঘর দুয়ারের কথা কমু। তারপর বেটারা আইস্যা ফটোক তুইল্যা নিয়্যা গেল, আপনেরা আইসলেন। মামুন বাবা ঘর দিল, ল্যাট্রিন দিল, চাল মুরগী, ডিম, নতুন কাপড় দিল আবার ট্যাকাও দিলো। মেলাদিন বাদে আমি নতুন জীবন পাইচি। শান্তিমতো আইজক্যা ঘুম আসবো। আমি অত্যান্ত খুশি। মামুন বাবাকে আল্লায় যেন বাইচ্যা রাখে আরও কত পরিবারকে জানি হে শান্তনা দিব্যার পারে
সমাজকর্মী সেতু বলেন, আমি এখানে প্রথম এসেছিলাম। এসে দেখি তিনজন মানুষ খুব খারাপ অবস্থায় থাকে। তিন বেলার কাছে একবেলা খায়। আমি একটা ভিডিও করি, সেটা মামুন ভাইয়ের কাছে চলে যায়। বিষয়টি দেশবিদেশে ছড়িয়ে যায়। মামুন বিশ্বাস ৯৯ হাজার টাকা পায়।
ফেসবুক ভিত্তিক সমাজকর্মী মামুন বিশ্বাস বলেন, বৃদ্ধ শাহিদা খালার একটি প্রতিবন্ধী স্বামী পরিত্যাক্তা মেয়ে, নাতিকে নিয়ে অসহায় ভাবে দিনযাপন করছিল। ৬ বছর আগে থাকার ঘরটা ঝড়ে উড়ে যায়, চট পলিথিন দিয়ে তৈরি ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। বিষয়টি জানতে পেরে তাদের নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট করি। এবং খুব দ্রুত দেশ ও দেশের বাইরে থেকে ৯৯ হাজার টাকা পাঠায়। সেই টাকা দিয়ে আজকে রঙিন ঘর, লেপ তোষক, খাদ্যসামগ্রী ওনাদের নতুন পোষাক দিয়েছি। দিন শেষে আমাদের একটাই বিজয় তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। ৬ বছর ধরে পলিথিনের মোড়ানো ঘরের কষ্ট থেকে তারা মুক্তি পেয়েছে এটাই আমাদের আত্মতৃপ্তি। আমরা চাই সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও যদি তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাহলে তারা অন্তত তিনবেলা খেতে পারবে।)
প্রসঙ্গত, নাবালিকা থাকতেই বিয়ারঘাট চরের আকতার হোসেনের সাথে বিয়ে হয় শাহিদা খাতুনের। তিন ছেলেমেয়ের জন্মের পর ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত হয়ে স্বামী মারা যান। তখন থেকেই চরে শাক-পাতা তুলে তা শহরে বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের বড় করেন। তিন শতক জমি কিনে সেখানে একটি ঘর তুলে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। তিনটি ছেলেমেয়েকেই বিয়েও দেন তিনি। কিন্তু দশ বছর আগে মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে তারাবানুকে তালাক দেয় স্বামী। সন্তানসহ মায়ের ঘরেই আশ্রয় নেয় তারাবানু।
কিছুদিন পর বড় ছেলে আতাউর স্ত্রী ও চার সন্তান রেখে মারা যায়। ছোট ছোট ছেলে নিয়ে বিধবা পূত্রবধু অন্যের বাড়ি কাজ করে আলাদা সংসারে করছেন। ছোট ছেলে সুজন তাঁতশ্রমিকের কাজ করে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি ভাড়া বাড়িতে থাকেন।
এভাবেই আবারও নিঃস্ব হয়ে পড়েন শাহিদা। বাড়িতে ছিল একটি ভাঙাচোরা টিনের ঘর। সেই ঘরখানা ছয় বছর আগে ঝড়ে উড়ে যায়। তখন থেকে পলিথিনের ঝুপরিতে তিন জনে বসবাস করছিলেন।