সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি:
বাঁশের খুঁটির উপর পলিথিনের ছাউনি। ভাঙা চৌকি, প্লাস্টিকের ছালা আর পুরাতন কাপড়ের তৈরি বেড়ার ঝুপরি একখানা ঘর। ঘরখানা দেখে মনে পড়ে যায় পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের কবিতার সেই আসমানী’র কথা।
“বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছাউনি, একটু খানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি” জসিম উদ্দিনের আসমানীদের সেই বাড়িটিকে হার মানিয়েছে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কালিয়া গ্রামের বিধবা শাহিদা বেগমের।
পার্থক্য হচ্ছে ৭৯ বছর আগে আসমানীদের ঘর ছিল ভেন্না পাতার ছাউনির, আর আধুনিক যুগে শাহিদাদের রয়েছে পলিথিন ছাউনি ঝুপরি। যার চারদিকে প্লাস্টিকের ছালার বেড়া। নেই কোন দরজা, জীর্ণ কাপড়ের পর্দা উঁচিয়ে ঢুকতে হয় ঘরটিতে। আর একটু বৃষ্টি হলেই পলিথিনের ফুটো দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। একটু ঝড়ো বাতাস বইলেই কাঁথা-বালিশ নিয়ে ছুটতে হয় প্রতিবেশীর বারান্দার দিকে।
স্বামী পরিত্যক্তা প্রতিবন্ধী এক মেয়ে ও ১২ বছর বয়সী নাতিকে এমনই একটি ঝুপরিতে ছয় বছর ধরে বাস করছেন শাহিদা বেগম (৬৫)। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেই নিরাবণ করতে হয় তিনটি প্রাণির পেটের খুদা।
“বিয়ে” কি বুঝতেন না’ তখন বিয়ারঘাট চরের আকতার হোসেনের সাথে নাবালিকা শাহিদার বিয়ে হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনটি সন্তানের জন্ম হয়। এরপর ১৯৮৮ সালের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান স্বামী আকতার।
স্বামীর মৃত্যুর পর দুঃখের দরিয়ায় পড়েন শাহিদা। চরে শাক-পাতা তুলে তা শহরে বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের বড় করেন। কালিয়া এলাকায় তিন শতক জমি কিনে সেখানে একটি ঘর তুলে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। তিনটি ছেলেমেয়েকেই বিয়েও দেন তিনি। কিন্তু দশ বছর আগে মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে তারাবানুকে তালাক দেয় স্বামী। সন্তানসহ মায়ের ঘরেই আশ্রয় নেয় তারাবানু।
কিছুদিন পর বড় ছেলে আতাউর স্ত্রী ও চার সন্তান রেখে মারা যায়। ছোট ছোট ছেলে নিয়ে বিধবা পূত্রবধু অন্যের বাড়ি কাজ করে আলাদা সংসারে করছেন। ছোট ছেলে সুজন তাঁতশ্রমিকের কাজ করে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি ভাড়া বাড়িতে থাকেন।
এভাবেই আবারও নিঃস্ব হয়ে পড়েন শাহিদা। বাড়িতে ছিল একটি ভাঙাচোরা টিনের ঘর। সেই ঘরখানা ছয় বছর আগে ঝড়ে উড়ে যায়। তখন থেকে পলিথিনের ঝুপরিতে তিন জনে বসবাস করছেন তিনি।
জীবনের গল্প বলতে গিয়ে শাহিদা বলেন, আমার জীবনটাই কষ্টের। আমার কপালে কোনদিন সুখ অইলো না। প্যান্ট পিন্দা থাইকতে বিয়্যা অইলো, স্বামীর বাড়ি থিক্যা দুইবার পলাইয়া আছি, আবার জোর কইর্যা পাঠাইয়া দিছে। পয়লা ছওয়াল অওয়ার পর সংসার বুঝছি। দুইটা ছওয়ালের পর মেয়েডা প্যাটে আসে। তারপর ডায়ারিয়া অইয়্যা স্বামী মারা গেল। ভাঙা ঘরে দুঃখ-কষ্ট করে খরি খুটেছি, শাক তুলেছি বেচেছি, বেটাবেটি নিয়্যা খাইয়া ভাঙা ঘরে শুইয়া থাকছি। ছয় বছর আগে ভাঙা ঘরডাও উড়ে নিয়ে গেল। আর ঘর তোলার ক্ষমতা হয় নাই। এইভাবেই কষ্ট করে চলছি। বাড়ি বাড়ি থেকে চেয়ে চিন্তে এনে খাই। মেয়েডা শাক তোলে বেটা নিয়ে বেচে। আটা এনে খাই। ঘর উড়ে যাওয়ার পর ছয় বছর এখানে থাকি।
ঝড় আসলে কাপড়চোপর নিয়্যা যাই। আবার চাইয়্যা চিন্তা আইনা চলি। এক ওয়াক্ত খাই, এক ওয়াক্ত নাও খাই। ভর্তা খেতে খেতে জীবনটাই শেষ। গোস্ত মাছ কোথায় পাবো। কোরবানি ঈদের মধ্যে চাইয়া-চিন্তা আইন্যা গোস্ত খাইছি। আর কোথায় পাবো। বড় একটা মাছ হইলে চাকা দিয়্যা চাইরডা ভাত খাইয়্যা এই ভাঙা ঘরে শুইয়্যা থাকতাম। বৃষ্টির মধ্যে সারারাত ঘুম হয় না।
নামাজ পইড়বার বসি তাও পানি পড়ে। আল্লাক বলি যে তুমি আমাক শান্তি দাও, আল্লাক ডাকলে বলে পাওয়া যায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, আল্লাও তো দেয় না।
ছোট ছেলে সুজন বলেন, মা মাইনসের বাড়ি কাজ কইর্যা আমাদের মানুষ করেছে। এখনও কাজকামই করে। আগে তো ভাঙাচোরা অইলেও একখান ঘর ছিল। এখন আর সেই ঘর নাই। আমি ওইপাড়া বউ ছেলেপেুলে নিয়ে ঘরভাড়া থাকি। পোলাপানের জন্য আমি ভাড়া বাড়িতে থাকি।
স্থানীয় হান্নান তালুকদার বলেন, শাহিদার স্বামী নেই। তার একটা ছেলে আছে, একটা মেয়ে আছে প্রতিবন্ধী। এই বিধবা মহিলা একটি কুঁড়েঘরে থাকে। একটু ঝড় আসলেই অন্যের বারান্দায় রাত্রিযাপন করা লাগে। দেখে কষ্ট লাগে, কিন্তু আল্লাপাক আমাদের সেই টাকাপয়সা দেয় নাই, যার কারণে সরকারের কাছে আবেদন ওনার জন্য যদি একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে বাকি জীবনটা ছেলেপুলে নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব নুরুল হক নয়ন
✆ ০৯৬৩৮-৯০৭৬৩৬। ই মেইল: thedailydrishyapat@gmail.com
।
Copyright 2025 Pratidinerdrishyapat