জহুরুল ইসলাম, শাহজাদপুর:
উত্তরবঙ্গের সর্বোবৃহৎ কাপড়ের হাট শাহজাদপুর। মোঘল আমলে শুরু হওয়া তাঁতে কাপড় বুনন প্রসারিত হতে হতে শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। এই শিল্প সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করে বৃহত্তর পাবনা জেলায় এবং এই শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিতি লাভ করে শাহজাদপুর। মুঘল আমলে যাত্রা শুরু করা এই শিল্পের প্রসার ঘটতে ঘটতে একবিংশ শতাব্দির শুরুর দশকে কেবলমাত্র শাহজাদপুরেই হাতে চালিত তাঁতের সংখ্যা দাড়ায় ১লাখ ৬২ হাজার। বিরাট এই সংখ্যার তাঁতের জন্যও নির্ভরযোগ্য জীবিকার মাধ্যম হয়ে ওঠে বিপুল সংখ্যক তাঁতশ্রমিকের জন্য। কিন্তু কালের বিবর্তে বিশ্বরাজনীতি এবং বাণিজ্যিক নানা কৌশলের মারপ্যাচে হারিয়ে যেতে বসেছে তাঁত শিল্প। শাহজাদপুরের পুরো অঞ্চল খুঁজে পাওয়ারলুম এবং হ্যান্ডলুম মিলে বড়জোর টিকে আছে ৫০ হাজারের মত তাঁত। এরফলে কর্ম হারিয়েছে অন্তত ১ লাখ ১২ হাজার তাঁতশ্রমিক।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতি বছরের এ সময়ে সনাতন ধর্মাবলস্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে বিপুল পরিমান তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছাসহ দেশীয় তাঁতবস্ত্র পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে রফতানী হতো। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (সাপটা চুক্তি) বাতিলসহ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চলমান নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন, স্থলপথে দেশীয় তাঁতবস্ত্র রফতানি বন্ধ, আমেরিকার প্রণয়নকৃত ৬০ শতাংশ ভারতীয় তাঁতবস্ত্রের ওপর শুল্ক আরোপের কু-প্রভাবসহ নানা কারণে দেশীয় তাঁতবস্ত্র ব্যবসা চরম সংকটের মুখোমুখি।
তাঁতবস্ত্রের অন্যতম ভরা মৌসুম দুর্গোৎসব উপলক্ষে এবার উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ শাহজাদপুর কাপড়ের হাট থেকে ভারতে কাঙ্খিত পরিমান তাঁতবস্ত্র রফতানি না হওয়ায় সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পে। ফলে দিনে দিনে বন্ধ হচ্ছে তাঁত, আর তাঁতী ও শ্রমিকরা হচ্ছে বেকার। তাঁতীদের ভাষ্যমতে, ‘মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরেই শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতি বছর দেশীয় তাঁতাবস্ত্রের বৃহৎ চালান ভারতে রফতানী হয়ে আসছে। ওই তাঁতবস্ত্র বিক্রির ওপরও স্থানীয় তাঁতীরা নীর্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকায় এবার সেই কাঙ্খিত লক্ষ অর্জিত না হওয়ায় ও কাপড়ের হাটে দেশীয় তাঁতবস্ত্রের বেচাকেনা মারাত্বক ধ্বস নামায় ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প চরম সংকটে পড়েছে!
শাহজাদপুর কাপড়ের হাট পরিদর্শনকালে দেশীয় তাঁতবস্ত্র উৎপাদনকারী তাঁতী ও মহাজনেরা জানান, প্রতি বছরের এ সময় কোটি কোটি টাকার তাঁতবস্ত্র ভারত, জার্মানী, ইটালী, ইংল্যান্ডসহ বহিঃর্বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে রফতানী করা হলেও মোট রফতানীর ৪০ ভাগ তাঁতবস্ত্রই যায় পশ্চিম বাংলার উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলী, বর্ধমান, নদীয়া, মূর্শীদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুঁড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কুচবিহার, হওড়া ও হুগলীসহ বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় নামিদামী শপিংমল ও বিপণী বিতানসহ ভারতের নানা প্রদেশে। নানা রং-বেরংয়ের বাহারী ডিজাইনের দেশি তাঁতের শাড়ীর গুণগত মান ও বাজার দর ভারতীয় বস্ত্র বাজারের অনুকূলে থাকায় শারদীয় দুর্গাপূজায় দেশীয় তাঁতবস্ত্রের ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
বিশেষতঃ ভারতীয় নারীরা দেশীয় তাঁত কারখানায় তৈরি সিল্ক জামদানী, সুতি জামদানী, কাতান, সুতি কাতান, রাজশাহী সিল্ক, বেনারশী, চোষা, শেড, বর্ণিল সুতা, স্বর্ণলতা, কটন, ব্লক ও চুমকির কাজ করা শাড়ীর ওপরই ঝুঁকে পড়েন। বিগত বছরগুলোতে ভারতীয় ব্যাপারী ও পাইকার একেকজন শাহজাদপুর কাপড়ের হাট থেকে এ সময় কমপক্ষে ২ হাজার জোড়া থেকে ১৫ হাজার জোড়া তাঁতের শাড়ি ক্রয় করলেও তাদের আগমনের সংখ্যা প্রায় না থাকার কারনে এবার দেশীয় তাঁতবস্ত্রের শতকরা ৭০ ভাগ বিক্রি কমে গেছে।
বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের পরিসংখ্যান অনুসারে দিনে দিনে দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্র হিসেবে সিরাজগঞ্জ ও কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে শাহজাদপুর দেশব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। শাহজাদপুরের তালতলা, খঞ্জনদিয়ার, রামবাড়ি, পুকুরপাড়, মনিরামপুর, প্রাণনাথপুর, শক্তিপুর, শান্তিপুর, থানারঘাটপাড়া, আন্ধারকোঠাপাড়া, রূপপুর, রূপপুর নতুন পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, উড়ির চর, নগরডালা, ডায়া, হামলাকোলা, জামিরতা, কৈজুরী, খুকনী, জালালপুর, পোতাজিয়া, গাড়াদহসহ নানা স্থানে তাঁতের সংখ্যা ছিলো ১ লাখ ৬২ হাজার প্রায়। শ্রমিকেরও সংখ্যা ছিলো আনুপাতিক হারে সমান। কিন্তু, পরপর কয়েকবারের বন্যা, করোনা ভাইরাস, হ্যান্ডলুমের স্থলে পাওয়ারলুমের প্রচলন, এবারে দুর্গাপূজায় ভারতে দেশীয় তাঁতবস্ত্রের একটি বৃহৎ অংশ রফতানী করতে না পারাসহ শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে বেচাকেনায় ধ্বসের কারণে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। পূঁজি সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে লাখো তাঁত বলে শাহজাদপুর তাঁত শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক মোঃ আল মাহমুদ এ প্রতিবেদককে মুঠোফোনে নিশ্চিত করেছেন।
তাঁতীরা আরও জানান, শাহজাদপুর, বেলকুচি আর এনায়েতপুরে প্রতি সপ্তাহেই হাট বসে। শাহজাদপুরে রবি ও বুধবার ; বেলকুচিতে মঙ্গল ও বুধবার এবং এনায়েতপুরে শুক্রবারে হাট বসে থাকে। লুঙ্গি আর থ্রি-পিসের জন্য বিখ্যাত বেলকুচির হাট। তবে শাহজাদপুরের হাটটিই এখন সবচেয়ে বড়। এসব হাটে প্রচুর দেশীয় শাড়ী ওঠে। পাইকার ছাড়াও সাধারন গ্রাহক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সেখান থেকে শাড়ি কিনে থাকলেও বর্তমানে সকল হাটেই বেচাকেনায় নেমেছে ধ্বস ।
ফলে এলাকার লাখো তাঁতীরা পরিবার-পরিজনের জীবীকা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে নতুন করে!
স্থানীয় তাঁতী মহাজনেরা জানান, ২০১০ সাল থেকে ভারতে রফতানী হচ্ছে শাহজাদপুরসহ পার্শ্ব¦বর্তী এলাকার তাঁতের শাড়ি। ভারতে যায় ৫’শ থেকে ৩ হাজার টাকা দামের শাড়ি। গত বছরগুলোর এ সময়ে সপ্তাহে কেবল শাহজাদপুর হাট থেকে কমপক্ষে ২’শ থেকে ৪’শ কোটি টাকার শাড়ী ভারতে রফতানী হতো ; আর বেলকুচি হাটের সাপ্তাহিক টার্নওভার ছিলো প্রায় ৩’শ কোটি টাকা। এই টার্নওভারের অন্তত: ৪০ শতাংশ আসে রফতানী থেকে। গত বছর পর্যন্ত এ চাহিদা ক্রমবর্ধমান থাকলেও এবারের চিত্র উল্টো।
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব নুরুল হক নয়ন
✆ ০৯৬৩৮-৯০৭৬৩৬। ই মেইল: thedailydrishyapat@gmail.com
।
Copyright 2025 Pratidinerdrishyapat