জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে বেতন–ভাতা নিয়ে ভয়াবহ অনিয়ম, দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে থাকা হিসাব সহকারী ও ৫ই আগস্ট থেকে পালাতক সহকারী শিক্ষক নিয়মিত বেতন তুলছেন, আবার দুই প্রতিষ্ঠানের বেতন ভাতা গ্রহণ করছেন এক নারী শিক্ষিকা। অধ্যক্ষ সায়ফুল ইসলামের স্বেচ্ছাচারিতায় ও যোগসাজশে অনিয়ম যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।
কলেজের হিসাব সহকারী মতিউর রহমান প্রায় দেড় বছর ধরে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। কোনো সরকারি ছুটি বা অনুমতি ছাড়াই তিনি প্রবাসে গিয়েও কলেজের হাজিরা খাতায় ‘নিয়মিত কর্মরত’ দেখানো হয়েছে। ব্যাংক স্টেটমেন্টে পাওয়া গেছে নিয়মিত বেতন উত্তোলনের প্রমাণও।
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাসখানেক আগেই তিনি গোপনে সৌদিতে যান। এরপরও কলেজ প্রশাসন বিষয়টি গোপন রেখে কাগজে-কলমে তাকে সক্রিয় কর্মচারী দেখিয়ে গিয়েছে।
কম্পিউটার ডেমো শিক্ষক নাজনীন সুলতানা—২০১৫ সালে কলেজে যোগ দিয়ে এমপিও পান। কিন্তু ২০১৭ সালে আক্কেলপুর ভানুকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেও কলেজের এমপিওভুক্ত বেতন তুলে আসছেন।
শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক মিজানুর রহমান ৫ আগস্টের পর থেকে অনুপস্থিত। তিনি কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। তার নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক মামলাও রয়েছে। এজন্য তিনি বিদ্যালয়ে আসেন না। তবে নিয়মিত স্বাক্ষর দেখিয়ে নিয়মিত বেতন উত্তোলন করেন।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন,
মিজানুর স্যার বহুদিন ক্লাসে আসেন না। আগে যেমন খেলাধুলা ও পড়াশোনা হতো, এখন আর হয় না।
অভিভাবক রফিকুল ইসলাম বলেন,
একজন বিদেশে থেকেও সরকারি বেতন তুলছেন—এটা চরম অন্যায়। দেশে এত বেকার তরুণ চাকরি খুঁজছে!
অভিযুক্ত হিসাব সহকারী মতিউর রহমানের স্ত্রী জানান,
তিন মাসের বেতন পেয়েছি। এরপর উনি বলেছেন আর লাগবে না। শোকজপত্র কেউ দেয়নি।
অভিযুক্ত সাবেক কম্পিউটার ডেমো শিক্ষক নাজনীন সুলতানা বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করার পর আমাকে কয়েকমাস সাসপেন্সনে রাখে। ৯ মাস আমি কোনো বেতন ভাতা পাইনি। পরে বাধ্য হয়ে আক্কেলপুর ভানুকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। ২০২৩ সালে আমি আমার ৯ মাসের বকেয়া বেতন উত্তোলন করি। তবে আমি এসব ঝামেলার মধ্যে থাকতে চাইনা, তাই সব টাকা ফেরত দিয়ে দিবো।
শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক মিজানুর রহমানের বক্তব্য নিতে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটিতে কয়েকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ক্ষেতলাল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ সায়ফুল ইসলাম বলেন,
মতিউর রহমান কমিটির থেকে ১ বছরের ছুটি নিয়েছিলেন। প্রবাসে যাওয়ার তিন মাস পর জানতে পারি তিনি বিদেশে গিয়েছে। তখন আমি বেতন বন্ধের জন্য লিখি। তবে সেটাতে কাজ হয়নি। এরপরও সে দীর্ঘদিন বেতন উত্তোলন করেছে। আগস্ট থেকে তার বেতন বন্ধ হয়েছে। তাকে সরকারি কোষাগারে বেতনের টাকা ফেরতের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত টাকা ফেরত দেননি।
দুই প্রতিষ্ঠানের বেতন নেওয়া নাজনীন সুলতানার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কমিটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে ২০১৬ সালের জুন থেকে ১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসের বেতন পাননি। তাই তার প্রাপ্য হিসেবে তাকে ২৩ সালে ওই ৯ মাসের বেতন সমন্বয় করে দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি কোনো ঝামেলার মধ্যে পড়তে চাননা তাই উত্তোলিত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।
শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক মিজানুর রহমানের বিদ্যালয়ে না এসে নিয়মিত বেতন উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জরিত ছিলেন, তার নামে কয়েকটা মামলাও হয়েছে। এজন্য তিনি নিয়মিত আসতে পারেন না।
তাহলে নিয়মিত স্বাক্ষর করে বেতন উত্তোলন করেন কিভাবে? জানতে চাইলে অধ্যক্ষ বলেন, মানুষটা মামলায় পড়েছে এইটুকু ছাড়তো দিতেই হয়।
প্রতিষ্ঠানের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব চপল বলেন, এসবতো আমার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে হয়েছে। তবে আমি জানতে পারার পর বেতন বন্ধ করে দিয়েছি। মিজানুর রহমানের বিষয়টিও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ক্ষেতলাল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (অতি.দা.) কাজী মনোয়ারুল হাসান বলেন, দুটি প্রতিষ্ঠানের বেতন ও প্রবাসে থেকেও বেতন উত্তোলন করার কোনো সুযোগ নেই। করে থাকলে অপরাধ করেছে। আমি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) রুহুল আমিন বলেন, বিষয়টি আমরা অবগত নয়। এই রকম ঘটনা ঘটে থাকলে তা নিঃসন্দেহে অনিয়মের ঘটনা। এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পেলে আমরা ডিপার্টমেন্টাল ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
ক্ষেতলাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানজিদা চৌধুরী বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি নতুন এসেছি। না জেনে তো বক্তব্য দিতে পারবো না। আগে যাচাই করে নেই। আপনি শিক্ষা অফিসারের সাথে কথা বলেন।







