নওগাঁ প্রতিনিধি:
আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন (৩৬)। রবিবার ১৮ আগষ্ট তাঁর ২৪তম মৃত্যু বার্ষিকী। আলফ্রেড সরেন একটি বহুল আলোচিত নাম। কারণ তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে আছে এক বিভবৎস কাহিনী। আলফ্রেড সরেন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে বসবাস করতেন।
২৪ বছর আগে অলফ্রেড সন্ত্রাসীদের দ্বারা নির্মম ভাবে নিহত হলেও এখনো ওই মামলার কোন সুরাহা হয়নি। আন্তর্জাতিক ভাবে আলোচিত ওই মামলার ভবিষ্যত নিয়ে আদিবাসীদের রয়েছে সংশয়। তাদের অভিযোগ জামিনে থাকা আসামীরা তাদের অব্যাহত ভাবে হুমকী-ধমকী দেয়ায় ইতোমধ্যে অনেক আদিবাসী পরিবার ভীমপুর আদিবাসী পল্লী ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। বর্তমানে যে ১২টি পরিবার এখনও বসবাস করছে তারা ভূমিদস্যুদের ভয়ে জমিতে চাষাবাদ করতেও পারছেনা। ফলে চরম অভাব অনটন ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যদিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। নিজেদের আশ্রয়স্থল পল্লী ছেড়ে মামলার সাক্ষীরা চলে যওয়ায় মামলার ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার বাদী আলফ্রেডের ছোট বোন রেবেকা সরেন।
ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে দেখা যায়, নিঝুম নিস্তব্ধ পল্লীটিতে প্রানচাঞ্চল্য আজ আর নেই। ঝোঁপ ঝারের মধ্যে বসবাস করছে এখনো কয়েকটি পরিবার। রেবেকা সরেন ও তার ছোট ভাই মহেশ্বর সরেন শত হুমকীর মধ্যে সেখানে রয়েছেন শুধু তার প্রান প্রিয় ভাইয়ের হত্যার বিচার দেখে যাওয়ার অপেক্ষায়। পল্লীর এক ধারে বাঁশ ঝাড়ের ছায়াঁয় অযত্নে পড়ে রয়েছে আদিবসী নেতা আলফ্রেড সরেনের সমাধী। আদিবাসীদের চোখে মুখে অতংকের ছাপ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার জামিনে থাকা আসামীদের অব্যাহত হুমকী ধমকীতে ২৪টি পরিবারের মধ্যে বর্তমানে নতুন ও পুরাতন মিলে সেখানে বসবাস করছে মাত্র ১২টি পরিবার। বাঁকীরা জীবনের ভয়ে অন্যত্র চলে গেছে। নিহত আলফ্রেড সরেনের বৃদ্ধ বাবা গায়না সরেন আজ আর বেঁচে নেই। ২০০৮ সালে তিনি মারা যান। তিনিও অব্যাহত হুমকী ধামকীতে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। আলফ্রেড সরেন হত্যা কান্ডের এক বছরের মাথায় তার মা ঠাকুরানী সরেন ছেলের শোকে মৃত্যু বরণ করেন। আলফ্রেড সরেনের স্ত্রী জোছনা সরেন বর্তমানে তানোরে থাকেন। মেয়ে ঝর্ণা সরেনের বিয়ে হয়েছে। সেও স্বামী সন্তান নিয়ে মায়ের কাছে থাকে।
আলফ্রেডের ছোট বোন রেবেকা সরেন সেদিনের ভয়াবহ ঘটনার বর্ননা দিতে গিয়ে বলেন, গত ১৮ আগষ্ট ২০০০ সালে ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে ভূমিদস্যু হাতেম-গদাই গংদের সন্ত্রাসীদের হামলায় তাঁর ভাই আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন নৃসংশভাবে খুন হন। ওই ঘটনায় সন্ত্রাসীরা ব্যাপক তান্ডব চালিয়ে আদিবাসী পল্লীর ১১টি পরিবারের বাড়িঘর ভাংচুর লুটপাটসহ অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময় তাদের হামলায় আদিবাসী মহিলা-শিশুসহ প্রায় ৩০ জন মারাত্মক আহত হয়। ঘটনার সময় আদীবাসীদের কয়েকজন শিশুকে সন্ত্রাসীরা পল্লীর পার্শ্ববর্তী পুকুরে নিক্ষেপও করেছিল। সন্ত্রসীরা যখন আদিবাসী পল্লীতে হামলা চালায় তখন বেলা ১২টা। ঘটনার দিনটি ছিল শুক্রবার। ওইদিন নওগাঁ-মহাদেবপুর সড়কের চৌমাসিয়ার মোড়ে জুম্মার নামাজের পর ভীমপুরের আদিবসীদের উপর ভূমিদস্যুদের অত্যাচারের প্রতিবাদে সমাবেশের আয়োজন করেছিল আদিবাসীরা। আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন সবকিছুর আয়োজন করে বেলা ১২টার দিকে বাড়িতে যান পান্থাভাত খেতে। পল্লীর অধিকাংশ পুরুষ ওই সময় চৌমাসিয়ার মোড়ে সমাবেশ স্থলেই ছিল। গ্রাম ছিল পুরুষ শূন্য। আলফ্রেড বাড়িতে যেতেই সন্ত্রাসী বাহিনী সেই সুযোগটি নিয়েছিল। আলফ্রেড বুঝতে পেড়ে নিজের ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে আশ্রয় নেন। আলফ্রেড যে ঘরটিতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন সেই ঘরটিতে তারা আগুন ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে আলফ্রেডকে বের হতে বাধ্যকরে। আলফ্রেড বেড়িয়ে আসা মাত্র ঘাতক সন্ত্রসীরা তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। তাকে যেকোন সময় হত্যা করা হতে পাড়ে এমনটি আঁচ করতে পেড়েছিলেন আলফ্রেড সরেন। সেদিন ওই সন্ত্রাসী ঘটনার সময় রেবেকা সরেন তাঁর ভাতিজী আলফ্রেড সরেনের মেয়ে ঝর্নাকে নিয়ে নিরাপদস্থানে লুকিয়ে ছিল। তবে সন্ত্রাষীদের আঘাতে আলফ্রেডের স্ত্রী জোছনা সরেনের একটি চোখ মারাত্নক ভাবে জখম হয়েছিল। পরবর্তিতে নিরাপত্তার জন্য সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছিল । পরে তা গুটিয়ে নেয়া হয়।
২০০০ সালের ৯ আগষ্ট নওগাঁর মুক্তির মোড় কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার পাদদেশে আন্তর্জাতিক আদিবসী দিবসে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাঁকে হত্যা করা হতে পারে এমন আশংকার বিষয় আলফ্রেড সরেন নওগাঁর সিপিবির নেতা ময়নুল হক মুকুল, মহসীন রেজাসহ আরো কয়েকজনকে বলেছিলেন সমাবেশের দিন । সবাই তাঁকে সতর্কভাবে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
আদিবাসীদের ডাকা চৌমাসিয়ার মোড়ে সেই সভায় সেদিন বক্তব্য দেয়ার জন্য উপস্থিত ছিলেন নওগাঁ সিপিবি’র সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ময়নুল হক মুকুল। তিনি সেদিনের সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, তখন দুপুর সাড়ে ১২টা হবে। হঠাৎ আমার নজর চলে যায় ভীমপুর গ্রামের দিকে। ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখি কুন্ডলি পাকিয়ে ওই গ্রামের উপড় ধোঁয়া উঠছে। আমি সবাইকে সেটা দেখতে বলি। ইতোমধ্যে মাঠের মধ্যে গ্রামের উদ্দেশ্যে দৌড় দেয় আদিবাসীরা। চৌমাসিয়ার মোড় থেকে গ্রামটি ভালভাবে দেখা যায়। আমিও আদিবাসীদের পিছু পিছু গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হই। তত:ক্ষন সব কিছু শেষ। আমি মহসীন রেজা, শহীদ হাসান সিদ্দিকী স্বপনসহ আরো কয়েকজনকে খবরটা জানিয়ে দেই। তবে আমার কাছে অবাক লেগেছে সেদিন পুলিশের তৎপরতা দেখে। অতদ্রুত পুলিশ কিভাবে খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। তখনই আমার ধারনা হয়েছিল পুলিশকে ম্যানেজ করেই ঘটনাটি ঘটিয়ে ছিল হাতেম-গদাই গং। পুলিশ সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে আলফ্রেডের লাশ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আমি আদিবাসীদের নিয়ে বাধা প্রদান করি। পুলিশকে বাধ্যকরি লাশের ময়নাতদন্তেরর জন্য।
আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় তার ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশ ৯১জন আসামীর নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। এর মধ্যে পুলিশ কয়েক জন আসামীকে গ্রেপ্তার করে। ওই সময় নওগাঁ দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষী গ্রহণ শুরু হয় এবং ৪১জন স্বাক্ষীর মধ্যে সেই সময় ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জননিরাপত্তা আইন বাতিল করে। ওই সময় পলাতক শীতেষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাই (বর্তমানে প্রয়াত) ও হাতেম আলীসহ ৬০ জনের অধিক আসামী জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে মামলাটি হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন। এর পর আসামীরা জামিনে বেড়িয়ে আসে। এ মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী এ্যাড. মহসীন রেজা জানান, বর্তমানে আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলাটি অ্যাপিলেড ডিভিশন শুনানী অন্তে নিস্পত্তি করে পুন:রায় পূর্নাঙ্গ শুনানীর জন্য হাইকোর্ট ডিভিশনে প্রেরণ করেছে।
আদিবাসী নেতাদের দাবি আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলাটি সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে যতদ্রুত সম্ভব নিস্পত্তি করা হোক। মামলাটি দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকায় অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আসামীদের বিভিন্ন হুমকীর ভয়ে অনেক সাক্ষী ভীমপুর আদিবাসী পল্লী ছেড়ে চলে গেছে।
নওগাঁ জেলা সিপিবি’র সভাপতি মহসীন রেজা বলেন, ভূমিহীন ও আদিবাসীদের দখলকৃত জমি তাদের ফেরৎ দিয়ে পূর্ন নিরাপত্তাসহ তাদের পূর্নবাসন করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ওই এলাকায় প্রচুর সরকারী খাস সম্পত্তি আছে। সেখানে আদিবাসী ও ভূমিহীনদের দখলে রয়েছে মাত্র ৩০ বিঘার মত।
বাসদ নওগাঁ জেলার আহবায়ক জয়নাল আবেদীন মুকুল আক্ষেপ করে বলেন, ২৪ বছরেও ওই মামলার নিস্পত্তি হলোনা। অথচ বিষয়টি ছিল স্পর্শকাতর।
তবে এতসব আশংকার মধ্যেও ১৮ আগষ্ট পালিত হবে নিহত আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনের ২৪ তম মৃত্যু বার্ষিকী।
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব নুরুল হক নয়ন
✆ ০৯৬৩৮-৯০৭৬৩৬। ই মেইল: thedailydrishyapat@gmail.com
।
Copyright 2025 Pratidinerdrishyapat